একটি ভবন নির্মাণের সময় নূন্যতম যে পরিমাণ মান নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন রয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা থাকে বিল্ডিং কোড তথা ভবন নির্মাণ বিধিমালায়। যে কোন ভবন নির্মাতা, কোন স্থাপনা নির্মাণের আগে অবশ্যই যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এই জাতীয় নির্মাণ বিধিমালা মেনে দরকারী ছাড়পত্র গ্রহণ করে তবেই ভবন নির্মাণের অনুমতি পায়। এরূপ জাতীয় নির্মাণ বিধিমালা থাকার মূল লক্ষ্য হল এই ভবনে বসবাসরত সকলের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পৃথিবীর সকল উন্নত দেশেরই এমন নিজস্ব ভবন নির্মাণ বিধিমালা রয়েছে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে রয়েছ বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড বা BNBC
বাংলাদেশের জাতীয় নির্মাণ বিধিমালা কীভাবে এল?
বাংলাদেশ জাতীয় নির্মাণ বিধিমালা বা ন্যাশনাল বিল্ডিং অ্যাক্ট প্রথম ১৯৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় দেশের তাবৎ ভবন নির্মাণের জন্য একটি মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং তা কার্যকর করবার লক্ষ্যে।এর আগে দেশে এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ কোন নীতিমালা ছিল না। বরং সেই ১৯৫২ সালে প্রাচীন পাকিস্তান আমলে প্রণীত ভবন নির্মাণ নীতিমালা বা বিল্ডিং কন্সট্রাকশন অ্যাক্ট দিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়া হচ্ছিল। পরবর্তীতে নব্বই সালের দিকে দেশে হঠাৎ করেই বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ জোরেশোরে আরম্ভ হলে একটি জাতীয় নির্মাণ বিধিমালার আশু প্রয়োজন দেখা দেয়। তার প্রেক্ষিতেই এই বিধিমালা প্রণীত হয় ১৯৯৩ সালে।
তবে প্রণয়নের সাথে সাথে সব কিছু সম্ভব হয়ে যায় নি। বরং বেশ কিছু কারণে এই বিধিমালায় কোন পরিবর্ধন বা পরিমার্জন সাধন করা যায়নি একটি বড় সময় ধরে। বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও এক্ষেত্রে বহুলাংশে দায়ী। অবশেষে ২০০৬ সালে দেশের ভবন নির্মাণ আইনের ১৮এর “ক” ধারার সংশোধনের মাধ্যমে জাতীয় নির্মাণ বিধিমালা একটি আইন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর রিয়েলে এস্টেট খাতে আরও বিশাল পট পরিবর্তনের কারণে ২০১৭ সালে এই আইনে বেশ কিছু সংশোধন এবং পরিমার্জন আনা হয় এবং একে একটি আধুনিক আইনে পরিণত করা হয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আমরা করব পরবর্তী অনুচ্ছেদে।
কারা এই বিধিমালা প্রণয়নে জড়িত ছিল?
হাউজিং এন্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট এই জাতীয় নির্মাণ বিধিমালার সামগ্রিক দেখভাল করে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যুরো অফ রিসার্চ, টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেন্সি, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সম্পর্কিত অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে এই নীতিমালার বিভিন্ন সংশোধন প্রণীত হয়েছে।
একটি ভবন নির্মাণে নূন্যতম মান নিয়ন্ত্রণ, নকশা, কাঁচামালের মান নিয়ন্ত্রণ, সঠিক ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ এবং ভবনটি যে স্থানে হবে সেই স্থান সম্পর্কে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন এবং প্রয়োগে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই নীতিমালা সঠিকভাবে বাস্তবায়নে স্থপতি, সেফটি ইন্সপেক্টর, নির্মাণ প্রকৌশলী, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার, পরিবেশ বিজ্ঞানী, ঠিকাদার, আইনজীবীসহ ভবনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব রয়েছে।
সংশোধিত বিধিমালার আকার
সর্বশেষ সংশোধিত জাতীয় নির্মাণ বিধিমালা ২০১৭-তে আছে ১০টি আলাদা অংশ যা মোট ৪৯টি অধ্যায়ে বিস্তৃত। সম্পূর্ণ নথিটির পরিব্যাপ্তি বিশাল, প্রায় ২০০০ পৃষ্ঠার, সেজন্য একে ৩টি আলাদা ভলিউম বা খন্ডে বিভক্ত রাখা হয়েছে। মূল ১০টি অংশ হল
সংজ্ঞা এবং পরিব্যাপ্তি, (Scope and Definitions) প্রশাসন এবং প্রয়োগ, (Administration and Enforcement) সাধারণ ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত মান নিয়ন্ত্রণ এবং নীতিমালা, (General Building Requirements, Control, and Regulation) অগ্নি নিরাপত্তা, (Fire Protection) ভবন নির্মাণ সামগ্রী, (Building Materials) স্থাপত্য নকশা, (Structural Design) নির্মাণকালীন নিরাপত্তা এবং সহসা পালনীয় নিয়মাবলী, (Construction Practices and Safety) ভবন কর্তৃক প্রদত্ত সার্ভিসসমূহ, (Building Services) বিদ্যমান ভবনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং ব্যবহার, (Alterations, Addition To and Change of Use of Existing Building) বাহিরে প্রদর্শনযোগ্য বিভিন্ন নির্দেশনা এবং ডিসপ্লে, (Signs and Outdoor Display) তন্মধ্যে ৬ষ্ঠ ভাগ তথা স্থাপত্য নকশা হল সবচেয়ে বড় অংশ যা ১০টি আলাদা অধ্যায়ে বিস্তৃত।
কী আছে এই সংশোধিত বিধিমালায়
এই বিধিমালা ১৯৯৩তে যখন প্রথম প্রস্তাবিত হয়, সেই সময় অনুসারে তা ঠিকই ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে আপডেট না হওয়ায় এবং রিয়েল এস্টেট খাতের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটায় দেখা যায় যে এটির পরিমার্জন জরুরী হয়ে পড়ে। গত ২০-২৫ বছরে আধুনিক ও উন্নতমানের নির্মাণ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। এছাড়াও ফায়ার সেফটি সম্পর্কে সম্মক আইন না মানায় অনেক বড় বড় দুর্ঘটনাও দেখা গিয়েছে অহরহ। তাই জাতীয় নির্মাণ বিধিমালায় পরিমার্জন হয়ে পড়েছিল জরুরী যা ২০১৭ সালে করা হয়
প্রস্তাবিত ২০১৭ এর নীতিমালায় পূর্বের সকল গুরুত্বপূর্ণ নীতিকে আত্মীকরণ করা হয়েছে এবং নতুন করে আধুনিক বেশ কিছু জিনিস যুক্ত করা হয়েছে। পরিমার্জন করা হয়েছে যেসব তারমধ্যে আছে স্থানীয় অথোরিটির আইনগত অধিকারক্ষেত্র, ভুমিকম্প সম্বন্ধীয় জোন ম্যাপ এবং নির্দেশনাবলী, বাতাসের গতি সম্বন্ধীয় জোন ম্যাপ এবং নির্দেশনাবলী ইত্যাদি। এছাড়া নতুন যোগ হওয়ার মধ্যে আছে এনার্জি এফিসিয়েন্সি ও সাস্টেইনিবিলিটি, রক্ষণাবেক্ষণ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, স্টিল – কংক্রিট স্থাপনা, বাঁশ দিয়ে তৈরি স্থাপনা ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন ফিগার নতুন করে আঁকা হয়েছে এই নির্দেশনাবলী আরও সহজবোধ্য ও নিখুঁত করার লক্ষ্যে।
পরিশেষে বলা যায় যে, সংশোধিত বিধিমালার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে দেশের স্থাপত্য, আবাসন এবং নির্মাণ শিল্পে তার প্রভাব পড়বে ব্যাপক। পৃথিবীতে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আলোচ্য একটি বিষয়, সাস্টেইনিবিলিটি বা দীর্ঘস্থায়ীত্ব নিয়েও এই বিধিমালায় আলোচনা করা হয়েছে। বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে যখন দেখা যায় দেশের অনেক ভবনই এখন “লিড সার্টিফিকেশন” নেয়ার চেষ্টা করছে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।