বাংলাদেশে বহুতালা ভবন নির্মাণে দুই ধরনের কংক্রিট স্লাব সিস্টেম ব্যবহিত হচ্ছে ।
০১. বীম কলাম স্লাব সিস্টেম ।
০২. ফ্লাট প্লেট স্লাব সিস্টেম ।

ফ্লাট স্লাভের ডিজাইন

বীম কলাম স্লাব সিস্টেমে মেঝে বা স্লাব এর সাথে বীম থাকে । তখন লোডের ট্রান্সফার ঘটে স্লাব থেকে বিমে তারপর বীম থেকে কলামে।

কিন্তু ফ্লাট প্লেট স্লাব সিস্টেমে স্লাব সাধারণত সরাসরি কলামের উপরে বসানো থাকে সেখানে বিমের ব্যবহার করা হয় না ।
স্ট্রাকচারাল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটি কোন নতুন আইডিয়া নয় । অতীতে সাধারণত কিছু বিল্ডিং এ ফ্লাট প্লেট স্লাব সিস্টেম ব্যবহার করা হত। কিন্তু বর্তমানে এই সিস্টেম টি কন্সট্রাকশন ফার্ম এবং ক্রেতাদের মধ্যেও দারুন জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ।

কাস্টমারের এই সিস্টেমে আকর্ষণ করার পিছনে কারন লক্ষ্য করা গিয়েছেঃ
⬛ স্লাব এর ভিতরের পৃষ্ঠ অনেক মসৃণ কারন ভিতরের দিকে বীম থাকে না
⬛ আরকিটেকচার আবেদন বৃদ্ধি করে ।

এসব কারনে বর্তমানে এই স্লাব সিস্টেমের ব্যবসাহিক চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে । এই জন্যও কন্সট্রাকশন কোম্পানিও ক্রেতা দের চাহিদার সাথে তাল মিলাচ্ছে। কিন্তু এটা আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে ভুমিকম্পের ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি ও ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা বীম স্লাব সিস্টেমের তুলনায় ফ্লাট প্লেট স্লাব সিস্টেমে অনেক বেশি।

বাংলাদেশে ছয় থেকে দশতালা এপার্টমেন্ট বিল্ডিং ঢাকা এবং অন্য বড় শহরে সাধারন ঘটনা। এই বিল্ডিং গুলোতে বীম কলাম স্লাব সিস্টেমে স্লাবের থিকনেস সাধারণত ১০০ মিমি থেকে ১২৫মিমি(৪”-৫”) হয়।
আবার ফ্লাট প্লেট স্লাব সিস্টেমে একই জাতীয় নির্মাণের ক্ষেত্রে স্লাব এর থিকনেস সাধারণত ১৭৫মিমি থেকে ২২৫মিমি বা তার থেকে বেশি হবে ।

সাধারণত বীম কলাম স্লাব সিস্টেমে বিল্ডিং এর ৭০ % ওজন আসে স্লাব থেকে । যেহেতু ফ্লাট প্লেট এর পুরুত অনেক বেশি থাকে তাই এই স্লাব এর ওজন তার থেকেও বেশি আসবে। কোন স্ট্রাকচারের ওজন যত বেশি হবে ভুমিকম্পের সময় ততবেশি এনার্জি উৎপন্ন হবে। এটা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে কেন জাপান যেখানে ভুমিকম্পের হার সবচেয়ে বেশি সেখানে বাড়ি নির্মাণে অনেক হালকা বস্তু যেমন বাশ, কাঠ , কাগজ ইত্যাদি ব্যবহার করে ।

আসলে ফ্লাট প্লেটের ক্ষেত্রে বিল্ডিং ভেঙ্গে পরার সম্ভাবনার কারন হচ্ছে স্ট্রাকচারের উপর আগত সিসমিক লোডের বৃদ্ধি। যখন বিল্ডিং ভুমিকম্পের সময় দোলতে শুরু করে তখন ইনারশিয়া বলের কারনে সিসমিক লোডকে বিল্ডিং এর পার্শ্বিক বল (লেটারাল লোড) হিসাবে বিবেচনা করা হয় । এর কারনে বিল্ডিং এ সর্বচ্চো পীড়ন উৎপন্ন হয় কলাম ও স্লাব এর জয়েন্টে । তাই এই জয়েন্ট এর জন্য সঠিক স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের প্রয়োজন । ইঙ্গিনিয়াররা ভুমিকম্প প্রতিরোধী বিল্ডিং ডিজাইনের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ নীতি মেনে চলে। এটি “ স্ট্রং কলাম উইক বীম” নামে পরিচিত । “এটি একটি ধারনা যে আশা করা হয় যে ভুমি কম্পের ফলে কলাম কে বাদ রেখে বিমের ইয়েল্ডিং এবং ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে আগত এনার্জি ছড়িয়ে দেওয়া হবে” ।

তারমানে কলামকে ডিজাইন করতে হবে অধিক শক্তিশালী করে। আসলে সম্পূর্ণ স্ট্রাকচারের শক্তি ও স্থায়িত্ব আসলে নির্ভর করে কলামের উপরে। তাই কলাম ব্যতিত বিমের এর ক্ষয়ক্ষতি হলে সেক্ষেত্রে উল্লেখ যোগ্য ভাবে সম্পূর্ণ কাঠামোর ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা কমিয়ে ফেলে। সাথে সাথে মানুষের মৃত্যু ঝুকিও কমিয়ে ফেলে।
এর পাশাপাশি এর উল্টো ঘটলে অর্থাৎ কলাম ফেইল করলে আসলে বিল্ডিং এর ওজনকে সাপোর্ট করার মত কিছুই থাকে না । সেক্ষেত্রে বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ে এবং সম্পদ এর ক্ষয়ক্ষতি হয় ও মানুষের জীবনের বিনাশ ঘটে।

এই “ স্ট্রং কলাম উইক বীম” ধারনা বিল্ডিং এ প্রয়োগ করা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য অনেক সহজ বীম কলাম স্লাব সিস্টেমে। ফ্লাট প্লেট সিস্টেম ডিজাইনে ইঞ্জিনিয়ারদের একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। এই ক্ষেত্রে যেহেতু বীম থাকে না তখন কলাম বরাবর স্লাব এর একটি অংশকে বীম হিসাবে মনে করা হয় । এই ধরনের সমস্যার জটিলতার কারনে বিএস সি লেভেলে এটি এড়িয়ে যাওয়া হয়। এর সাথে সাথে আরও আশ্চর্যের বিষয় যে বেশির ভাগ ডিজাইন কোডও এই ব্যাপারে বিস্তারিত ভাবে বলা থাকে না ।
যদি কলাম খুবই শক্তিশালী ভাবে ডিজাইন করা হয় তখন কলামের চারিদেকে স্লাব ক্ষতি গ্রস্থ হয়। এর কারনে কলামের কাছে উচ্চ পীড়নের সৃষ্টি হয় যা পাঞ্ছিং শেয়ার ফেইলর এ নিয়ে যায়। তখন স্লাব কলাম থেকে ভেঙ্গে পরে এবং পরবর্তীতে যার ফলে কাস্কেডিং এফেক্ট শুরু হয় এবং সম্পূর্ণ বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ে। ফ্লাট প্লেট স্লাব এর জয়েন্ট এর স্লাব থিকনেস নির্ধারণে এই ফেইলরটি সবচেয়ে ক্রিটিকাল। যদি স্লাব থিকনেস অনেক বেশি হয় তবে কলাম দুর্বল হয়ে পড়বে যেটা কাম্য নয়। বীম স্লাব সিস্টেম এ এমন ধরনের কোন সমস্যা নেই। এমনকি যদি কখনও বীম ফেইল করে তারপরও স্লাব এর সহজাত বৈশিষ্টের কারনে স্লাব ফেইল করার সম্ভাবনা অনেক কম।

ফ্লাট প্লেট স্লাব এর ডিজাইন অনেক জটিল এবং এটি নির্মাণে অধিক পরিমানে কারিগরি জ্ঞান ও অত্যধিক তদারকির প্রয়োজন।আমাদের দেশে অতীতে যে সকল বিল্ডিং এ ভুমিকম্প ও নির্মাণ ত্রুটির কারনে স্ট্রাকচারাল ফেইলর হয়েছে তা বেশির ক্ষেত্রেই ফ্লাট প্লেট সিস্টেমে দেখা গিয়েছে। তাই সহজেই বলা যায় বীম কলাম স্লাব সিস্টেম ফ্লাট প্লেট সিস্টেমের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ। এই সিস্টেমের আরেকটা বড় বিষয় হল এটি নির্মাণে অধিক পরিমানে কন্সট্রাকশন ম্যাটেরিয়ালস প্রয়োজন হওয়ার নির্মাণ খরচ অনেক বেড়ে যায়।

তবে এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করতে হবে যে এই আলোচনা সাধারনভাবে প্রযোজ্য হবে ওই সকল ফ্লাট প্লেট সিস্টেম বিশিষ্ট বহুতালা বিল্ডিং এর ক্ষেত্রে যেখানে লোড কলামের মাধ্যমে সরাসরি ফাউন্ডেশনে যায়। যেখানে কলাম প্রধান লোড ট্রান্সফারের কাজ করে । অনেক সময় বিল্ডিং নির্মাণে বাইরের ওয়াল থেকে লেটারাল লোড ও ফ্লোর থেকে আগত লোড ট্রান্সফার করার জন্য রেইনফোসড কংক্রিট ওয়াল কলামের দিকে ব্যবহার করা হয় । এই ধরনের টেকনিকাল ওয়ালকে “শিয়ার ওয়াল” বলে। যেসব বিল্ডিং এ শেয়ার ওয়াল এর সাথে সাথে পাইল অথবা ম্যাট ফাউন্ডেশন থাকে সেসব বিল্ডিং ভুমিকম্পের সময় অধিক প্রতিরোধী হয়। এই ক্ষেত্রে ক্ষয় ক্ষতির ঝুকি অনেকাংশে কমে যদি এটি ফ্লাট প্লেট স্লাব হয় তবুও।
তবে এটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে এক্ষেত্রে অবশ্যই যেন পাইল, ম্যাট বা একই রকমের ডিপ ফাউনডেশন যেন এই সকল বিল্ডিং এর নিচে থাকে। শুধু মাত্র যদি শিয়ার ওয়াল যদি ব্যবহার করা হয় সাথে যদি প্রত্যেক কলামে অগভীর ফাউন্ডেশনে ব্যবহার করা হয় সেক্ষেত্রে কিন্তু ঝুকি কমবে না।

বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে এই বিষয় নিয়ে বিস্তর গবেষনা হয়েছে এবং প্রমানিত হয়েছে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।